দেশের বিলুপ্তপ্রায় শিকারি স্তন্যপায়ী প্রাণীবৈচিত্র্য

বাঘ এবং সুন্দরবন। আমাদের জাতীয় পশু, গর্বের বন; কিন্তু এই লেখাটি বাঘ এবং সুন্দরবন কোনোটিরই নয়। বাঘ ছাড়াও এদেশে প্রায় ৩০ ধরনের প্রাণী আছে, যাদের বিবর্তনের ইতিহাস ঠিকুজি অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে এই প্রাণীরা নানাভাবে বাঘের মাসি-পিসি, সম্পর্কিত। এই প্রাণীরা বাংলাদেশের সদা ক্ষয়িষ্ণু বন থেকে শুরু করে জলাভূমিতে, এমনকি গ্রামীণ ঝোপঝাড়েও বাস করে। তবে এই শিকারি প্রাণীদের নাম জিজ্ঞেস করা হলে আমাদের দৌড় কিন্তু সেই বাঘেই ঘুরপাক খায়। দেশে চিতাবাঘ বা লেপার্ড আছে কিনা সে চিন্তাতেও আমরা দোদুল্যমান থাকি। বাকি নামগুলো মনে করা তো দূর অস্ত।

তবে তারা আছে। আমাদের মনোযোগ যতই বাঘে আটকে থাকুক, তারা আছে। দাঁতে দাঁত চেপে, বনে, জলাভূমিতে। এই প্রাণীদের কোনো কোনোটি বাঘের থেকে কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, ক্ষেত্রবিশেষে বরঞ্চ বেশি। এই প্রাণীদের নিয়ে যেমন আমাদের ভাবনা কম, তেমনই জানাশোনা কম, গবেষণা নেই বললেই চলে, সংরক্ষণ উদ্যোগ অপ্রতুল। এই নেতিবাচকতার প্রভাব কিন্তু সুদূরপ্রসারী। আমাদের বন-বুনো পরিবেশগুলোতে ধরেই নিচ্ছি এরা নেই। সেই পরিবেশে গুরুত্ব কমছে। বিভিন্ন রকম উন্নয়নের কাঁচি চলছে। দুষ্টচক্রে বন হারাচ্ছি, হারাচ্ছে বাঘের মাসি-পিসিরাও। 

চিতাবাঘের কথা বলেছি। এই পর্যন্ত এসে আমাদের আরো কিছু নাম মনে আসতে পারে। ভালুক আসবে। যাদের বন-বনপ্রাণী নিয়ে আগ্রহ আছে তাদের কল্পনায় গেছোবাঘ এসে ঘুরে যাবে। রামকুকুর আসতে পারে। আমরা জানি আমাদের সুন্দরবনে ১১৪টির মতো বাঘ আছে। আমদের কতগুলো ভালুক আছে? বনে চিতাবাঘ-গেছোবাঘ-রামকুকুরের সংখ্যাই বা কত? আমাদের জানা নেই। আমারও নেই। এই লেখাটি তাই বাংলাদেশের এই অপরিচিত কিন্তু অপূর্ব, অসাধারণ শিকারি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নিয়ে। 

শিকারি স্তন্যপায়ী প্রাণী কারা? 

মেরুদণ্ডী স্তন্যপায়ী প্রাণীদের একটি বর্গ বা Order মাংসাশী বা শ্বাপদপ্রাণীদের বর্গ কার্নিভোরা (Carnivora)। তবে এদের সবাই যে মাংস খায় সেটি কিন্তু নয়। বৈচিত্র্যময় এই বর্গটিতে যেমন বিশালাকার ভালুক পাওয়া যায় তেমনই বেড়ালের বাচ্চার আকৃতির প্রাণীও আছে। এবং এদের সবাই মাংসাশী নয়। যেমন ভালুক, শেয়াল, খেঁকশিয়াল ইত্যাদি খাদ্যাভ্যাসের হিসাবে সর্বভুক। আবার, বৃহৎ পাণ্ডা সম্পূর্ণ নিরামিষাশী, কেবল বাঁশ পাতা খেয়ে থাকে। আবার সুযোগ পেলে বানর-বেবুন ও মাংস খেয়ে থাকে। তাই বলে তারা কিন্তু কার্নিভোরা বর্গের অন্তর্ভুক্ত নয়। 

শ্বাপদ বা শিকারি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো কার্নাসাল (Carnassial) নামে কাঁচির মতো মাংস কাটতে পারে এমন দাঁত। ওপরের এবং নিচের চোয়ালের পেষক দাঁতের (pre-molar Ges molar) সমন্বয়ে কার্নাসাল গঠিত। এগুলো চোয়ালবদ্ধ অবস্থায় খাঁজে খাঁজে ঢুকে যায়। বিবর্তন প্রক্রিয়ায় কিছু কার্নিভোরা তাদের খাবারে পরিবর্তন হয়েছে। তাই এই কার্নাসাল অনেকভাবেই পরিবর্তিতও হয়েছে। বাগদাশাদের কার্নাসালসিংহ-বাঘ-হায়নাদের থেকে কম শক্তিশালী। মাছখেকো উদদের কার্নাসাল সমান ও ছোট ছোট স্ফীতি (tubercle) যুক্ত। পাণ্ডাদের তো নেই বললেই চলে।

তাই শ্বাপদ বা শিকারি স্তন্যপায়ী প্রাণী হতে হলে কোনো প্রাণীর নিজের কার্নাসাল দাঁত না থাকলেও তার পূর্বপুরুষের থাকলেই চলবে। এদের বিজ্ঞানীরা অনেক পরিবারে (Family) ভাগ করেছেন। বাংলাদেশে এখনো রয়েছে ছয়টি পরিবার। 

আট ধরনের বুনো মার্জার

এরা বাঘের সঙ্গে একই ফেলিডাই (Felidae) পরিবারের অন্তর্গত। বাঘ, চিতাবাঘসহ আরো ছয় ধরনের বন্য বিড়ালজাতীয় প্রাণী আমাদের বন, গ্রামীণ বনে বাস করে। এর মাঝে বনবিড়াল, চিতাবিড়াল, মেছোবিড়ালদের এখনো মানুষের কাছাকাছিই দেখা যায়। তবে এরা ছোট আকৃতির। বাসার পোষা বিড়াল থেকে সামান্যই বড় হয়। আর তিন প্রজাতি খুবই দুর্লভ। মর্মর বিড়াল, সোনালি বিড়াল এবং গেছোবাঘ আমাদের সিলেট-মৌলভীবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে এখনো মাঝে মাঝে দেখা যায়। এদেশে এদের কোনোটিকেই এখনো পাঁচ-সাত বারের বেশি দেখা যায়নি।

বাংলাদেশে আরেক ধরনের বুনো বিড়াল ছিল। এ দেশ চিতা (cheetah) হারিয়েছে প্রায় ১০০ বছর আগে। উত্তরবঙ্গের দিগন্ত বিস্তৃত বিরানভূমিতে এরা ঘুরে বেড়াত। অনেকে চিতা আর চিতাবাঘ মিলিয়ে ফেলেন। আদতে দুটিই সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন প্রাণী। চিতাবাঘ আকারে ভারী, বড়; বন থেকে শুরু করে আখ-ভুট্টাক্ষেত, শহরের পাশেও থাকার জন্য অভিযোজিত। চিতা হালকা গড়নের, দ্রুতগামী। চিতার বসবাসের জন্য ফাঁকা ঘাসজমি বা সাভানা-ধরনের (savannah) কম ঘন বনের বাসস্থান প্রয়োজন। আবাস ধ্বংস, শিকার, পোষ মানানোর জন্য বাচ্চা আহরণ এ প্রজাতিটির বিলুপ্তির কারণ। বলা হয়ে থাকে মোঘল সম্রাট আকবরের প্রায় হাজারটি চিতা ছিল। এশিয়াতে এখন চিতা শুধু ইরানেই পাওয়া যায়। সংখ্যা মাত্র ৫০-৬০টি। 

বুনো সারমেয় সংখ্যা তিন

শিয়াল, খেঁকশিয়াল আর ঢোল। এই তিনটি হচ্ছে আমাদের কুকুর বা সারমেয় সম্পর্কিত মাংসাশী স্তন্যপায়ী প্রাণী। শিয়াল প্রায় সারাদেশেই এখনো পাওয়া গেলেও খেঁকশিয়ালের দেখা মেলে শুধু উত্তরবঙ্গে এবং মৌলভীবাজারের চা বাগানগুলোতে। ঢোল বা রামকুকুরের বাস সিলেট-মৌলভীবাজার এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে। সারা পৃথিবীতে রামকুকুরের সংখ্যা কিন্তু বুনো পরিবেশে বাঘের থেকেও কম। শিয়াল-খেঁকশিয়াল আর যে কোনো কুকুরের মতোই এরাও দলবদ্ধভাবেই চলে ফেরে। অসম্ভব সাহসী এই প্রাণীটি প্রয়োজনে বাঘ-চিতাবাঘকেও ছেড়ে কথা বলে না। অথচ, এদেশে যে এরা এখনো আছে সে সত্যটি খুব কম জনেরই জানা আছে।

এ দেশে কিন্তু একসময় নেকড়েও পাওয়া যেত। চিতার সমসাময়িক সময়ে নেকড়েও এদেশ থেকে বিদায় নেয়। নেকড়েদেরও পচ্ছন্দ কিন্তু খোলা জায়গা। সারমেয়জাতীয়দের পরিবার ক্যানিডাই (Canidae) এ নেকড়েরাই সবচেয়ে বড়। 

কালো ভালুক এবং সূর্য ভালুক 

বাংলাদেশের ভালুক প্রজাতি দুই। দুটিই পূর্বাঞ্চলীয় বনে বাস করে। এর মাঝে কালো ভালুকটি বেশি দেখা যায়। সূর্য ভালুক আকারে কিছুটা ছোট। এবং বেশি দুর্লভ। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে এদের অল্পবারই দেখা গিয়েছে। ভালুক পরিবার আরসিডাই (Ursidae)-এর প্রজাতি সংখ্যা সাত। বাংলাদেশ একটি প্রজাতি হারিয়েছে শ্লথ বা মন্থরগতির ভালুক (Sloth bear)।

বাগদাশ, খাটাশ ও বাঁশভালুক

শরীরে পোলাও চালের মতো ঘ্রাণ আছে এমন প্রাণীদের কথা গ্রাম-মফস্বলে এখনো শোনা যায়। এরা বাগদাশ এবং খাটাশ। এদের পরিবার ভিভেরিডাই (Viverridae)। এদের মাঝে বড় বাগদাশ, ছোট বাগদাশ ও গন্ধগোকুল বা নোঙ্গর গ্রামীণ বন, পোড়া জমি, কবরস্থানে বাস করতে পারে। বাকি তিনটি বনেই বাস করে। বড় আর ছোট বাগদাশ বাদে বাকিরা বেশ ভালো গাছে চড়তে পারে। 

বাঁশভালুক নামে হলেও এই প্রাণীটি মোটেও ভালুক নয়। শরীরের লম্বা, ঘন লোমের কারণে প্রাণীটিকে অনেকটা ভালুকের মতো দেখায়। সেই থেকেই এই নাম। গাছ বা বাঁশঝাড় চড়ায় দক্ষ এই প্রাণীটি কিন্তু একেবারেই হিংস্র নয়। 

বাকি দুইটির একটি মুখোশধারী নোঙ্গর আর তিন দাগী নোঙ্গর। শেষেরটি অসম্ভব দুর্লভ। দেশে এখন পর্যন্ত কোনো নমুনার সন্ধান পাওয়া যায়নি। এই প্রাণীরা ফল, ছোট প্রাণী বা পোকামাকড় খেয়ে থাকে। গ্রামীণ বন দ্রুত শেষ হয়ে আসায় অনেক সময়ই মুরগি খেতে এসে মানুষের হাতে মারা পড়ে। নতুন নতুন রাস্তা তৈরি হওয়ার কারণে, বিশেষত মাওয়া আর ফরিদপুরের এক্সপ্রেসওয়েতে প্রায়ই এদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। 

 বেজি

আমাদের অতি পরিচিত বেজি কিন্ত কার্নিভোরা বর্গের একটি প্রাণী। তিন ধরনের বেজির দুইটি, ছোট দেশি বেজি ও ধূসর বেজি সারা দেশেই পাওয়া যায়। কাঁকড়াভুক বেজির দেখা সহজে মেলে না। এরা মিশ্র চিরসবুজ বনেই বাস করে। বেজিদের পরিবার হারপেস্টিডাই (Herpestidae)। 

উদ্বিড়াল 

‘ওরে ভোঁদড় ফিরে চা, খোকার নাচন দেখে যা’ কবিতার প্রিয় ভোঁদড় বা উদ্বিড়ালের কিন্তু একটি নয় বরঞ্চ তিন তিনটি আলাদা আলাদা প্রজাতি কিন্তু আমাদের দেশে আছে। পৃথিবীর ১৩ ধরনের উদবিড়ালের মাঝে ছোট নখযুক্ত উদ্বিড়াল, মসৃণ-চামড়ার উদ্বিড়ালও ইউরেশীয় উদ্বিড়াল আমাদের। এরা উপকূলীয় বন, পদ্মা-যমুনার চরের ঘাসজমি আর ছড়াযুক্ত বন, এই তিন ধরনের পরিবেশেই আছে। নামে উদ্বিড়াল হলেও এরা কিন্তু বিড়াল নয় মোটেও। 

মজার ব্যাপার হচ্ছে, গত বছর পর্যন্তও আমাদের জানা ছিল না যে আমাদের পূর্বাঞ্চলীয় বনে ছোট নখযুক্ত উদ্বিড়াল আছে। এর আগে এরা শুধু সুন্দরবনে আছে বলেই ধারণা করা হতো। প্রায় ১০০০ কিলোমিটার দূরে এদের উপস্থিতি আশাজাগানিয়া।

মসৃণ-চামড়ার উদ্বিড়াল উপকূলীয় বন আর চরের ঘাসজমিতেই বাস করে। তবে, সংখ্যায় কম। 

শংকার বিষয় হচ্ছে, মসৃণ-চামড়ার উদ্বিড়াল আর ইউরেশীয় উদ্বিড়ালের আবাসস্থল হিসেবে পূর্বাঞ্চলীয় বনকে ধরা হলেও এখন পর্যন্ত এদের কোনো হদিস সেখানে পাওয়া যায়নি। ইউরেশীয় উদ্বিড়ালের কোনো নমুনা এদেশে বিগত ৩০ বছরেও বিজ্ঞানীরা শনাক্ত করতে পারেননি। ইউরেশীয় উদ্বিড়াল আমাদের পরবর্তী বিলুপ্ত প্রাণী হতে পারে। মাছ ধরতে ও খেতে দক্ষ উদ্বিড়াল মাস্টেলিডাই (Mustelidae) নামে একটি বড় পরিবারের অন্তর্গত।

‘বিবিধ’ প্রজাতি 

মাস্টেলিডাই পরিবারের আরো কিছু প্রাণী আমাদের আছে। হগ ব্যাজা, দুই ধরনের ফেরেট ব্যাজা আর হলদে-গলা মারটেন মিশ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। এই প্রাণীদের সম্পর্কে সারা পৃথিবীতে খুব কম মানুষই জানেন। হগ ব্যাজা আর মারটেন কমবেশি দেখা গেলেও ফেরেট ব্যাজার হদিস এখন পর্যন্ত একটিই পাওয়া গিয়েছে। মারটেন বাংলাদেশে প্রথম আবিষ্কার হয়েছে ২০১০ সালে। এই ছোট কিন্তু সুন্দর প্রাণীদের কোনো প্রচলিত বাংলা নাম নেই। 

হগ ব্যাজাকে অনেকে গোরখোদক ডাকলেও মৃতদেহের সঙ্গে নামের কোনো সম্পর্ক নেই। প্রাণীটি কেঁচো খুবই পছন্দ করে, সঙ্গে মাটির নিচের নানা পোকামাকড় খেয়ে থাকে। মাস্টেলিডাই পরিবারের আরো দুইটি প্রাণী আমাদের দেশে পাওয়া যেতে পারে। বেজি বা নেউলের মতো দেখতে উইজলদের দুইটি প্রজাতি মিশ্র চিরসবুজ বনে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়।

বাঘ বনাম অন্যান্য

এই যে এত প্রজাতি, এদের নিয়ে গবেষণা খুব বেশি হয়নি। আমাদের বাঘ নিয়ে সাতটি পিএইচডি গবেষণাসহ প্রায় ৫০টি বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলেও বাকিদের নিয়ে কিন্তু কাজ নামেমাত্র। গত বছর পর্যন্ত বাংলাদেশই ছিল একমাত্র দেশ যে দেশে চিতাবাঘ নিয়ে একটি গবেষণাও ছিল না। আমদের রাম কুকুর নিয়ে একমাত্র কাজটি ২০১৮ সালে আলোর মুখ দেখেছে। আমদের ভালুক আর গেছোবাঘ নিয়ে এখনো কোনো গবেষণা কাজ হয়নি।

সব মিলিয়ে আমাদের গ্রামীণ বনে ১১ ধরনের শিকারি স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। কিন্তু তাদের বাঁচানোর জন্য একটি উদ্যোগও নেই। বিস্মৃতির অতলে যেতে থাকা এই প্রাণীদের সাধারণ মানুষ উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবে বাঘ আর বাঘের বাচ্চা ভেবে মেরে ফেলে। সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে মেছোবিড়াল-মানুষের সংঘাত খবরে আসছে।

বাঘ নিয়ে আমাদের কাজ প্রশংসনীয়; কিন্ত বাঘের বাকি ২৭ আত্মীয়দের বাদ দিয়ে কী পুরো সফলতা অর্জন করা সম্ভব? কিংবা মানুষের সঙ্গে ঘরের পিছনে থাকা বনবিড়ালের সম্পর্ক ঠিক না করে কী বাঘ নিয়ে আমদের ভালোবাসা জাগিয়ে তোলা সম্ভব? 

সুন্দরবন বনাম পাহাড়ি বন 

এই যে আমাদের এত এত শিকারি স্তন্যপায়ী প্রাণী, তাদের প্রায় সবই কিন্তু আমাদের মৌলভীবাজার আর পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে পাওয়া যায়। এমনকি বাঘের উপস্থিতির কথাও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে শোনা যায়। সুন্দরবনে কিন্তু বাঘ ছাড়া মাত্র ৬ থেকে ৭টি প্রাণী বাস করে। এর মাঝে আছে বনবিড়াল, চিতাবিড়াল আর মেছোবিড়াল। আছে শিয়াল আর তিন ধরনের বাঘদাশ ও খাটাশ। আমাদের মৌলভীবাজার আর পার্বত্য চট্টগ্রামের বনে অনেক প্রাণী আছে। অথচ এই দুই বনে শিকারি স্তন্যপায়ীদের ওপর চালানো গবেষণার সংখ্যা মাত্র ১২টি যেখানে, সুন্দরবনে বাঘ নিয়ে গবেষণা প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। 

পরিবর্তনের যাত্রাটি কঠিন 

‘মৌলভীবাজারের বনে তো মায়া হরিণই নেই।’ আমাকে কথাটি বলা হয়েছিল ২০১৮ সালে। সময়টিতে আমি মাংসাশী স্তন্যপায়ীদের নিয়ে আমার প্রথম গবেষণার পরিকল্পনাটি করছি। ইংল্যান্ড থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে আসা জনৈক গবেষকের কথায় আমি টলে যাইনি। 

এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তিও আছে। প্রাণী-ভৌগোলিক অবস্থানের কথা বিবেচনা করলে বিষয়টি সহজ হয়ে যায়। বাংলাদেশের অবস্থান দুই প্রাণী-ভৌগোলিক অঞ্চল, নিম্নদেশীয় হিমালয় (Lower Himalaya) ও ইন্দো-বার্মা’র কোল ঘেঁষে। সেই সাথে, ত্রিপুরার পাহাড়শ্রেণির পুরো উত্তর প্রান্ত এই মৌলভীবাজারে এসে মিশেছে।

এই এলাকার বন নিয়ে আমাদের প্রায় সব গবেষকের মাঝে এই অবহেলার ধারণাটিই প্রকট ছিল কিছুদিন আগ পর্যন্তও। ধারণার পরিবর্তন ধীরে ধীরে হলেও গবেষণা-সংরক্ষণ নিয়ে কিন্তু আমাদের এখনো যোজন-যোজন পথ বাকি। পুরো পূর্বাঞ্চলীয় বনে মাত্র ১০ শতাংশেরও কম বন বন্যপ্রাণীদের জন্য সংরক্ষিত, যেখানে বনভূমির পরিমাণ প্রায় ৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার। 

২০১৮ সাল থেকে রিমোট ক্যামেরা-ট্রাপ পদ্ধতিতে চালানো এই গবেষণা থেকে আমরা এখন পর্যন্ত মৌলভীবাজারের বনে জানতে পেরেছি সোনালি বিড়াল, ঢোল, ভালুক, উদবিড়ালের অস্তিত্ব। 

 বৈচিত্র্যই সৌন্দর্য

ত্রিশ প্রজাতির শিকারি স্তন্যপায়ী প্রাণী। সংখ্যাটি কিন্তু কম নয়। ভারতে এ সংখ্যাটি ৫৭, নেপালে ৪৭, আর ভুটানে ৩৯। এত ছোট, ঘনবসতিপূর্ণ আর নিতান্তই অল্পবনের দেশে এতগুলো বিচিত্র, বিপন্ন প্রাণীর অস্তিত্ব কিন্তু দারুণ গর্বের। আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা আমাদের বনকে কীরকম দেখতে চাই! আমাদের বনে শুধু বাঘ থাকবে এটি যেন শুধু আমাদের চাওয়া না হয়। হায়েনাসহ ইতিমধ্যে বাংলাদেশ চারটি শিকারি স্তন্যপায়ী প্রাণী হারিয়েছে। আর একটিও যেন না হারায় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। প্রতিবছর শীতে ক্যামেরা ট্রাপিংসহ নানা গবেষণা করতে হবে। মানুষের সঙ্গে শিকারি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের সহাবস্থানে কাজ করতে হবে। বাঘ নিয়ে আমাদের দুইটি বিশ বছর মেয়াদি সংরক্ষণ পরিকল্পনা আছে। ভালুক, ঢোল, চিতাবাঘ নিয়ে আমাদের সেভাবেই কাজ করতে হবে। আমাদের ভালোবাসাই পারে আমাদের বিপন্ন, বিলুপ্তপ্রায় শিকারি স্তন্যপায়ী প্রাণীদের নিয়ে উদাসীনতা কমাতে আর সংরক্ষণ কাজগুলো জোরদার করতে।

মনে রাখতে হবে, পরিবেশ ও বন্যপ্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষা করা মানবজাতির টিকে থাকার স্বার্থেই প্রয়োজন।


লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //